আবার এসেছে বিজয়া দশমী ॥ অতলান্তিকের দেশ থেকে
- Oct 15, 2018
- শরীফা খন্দকার
প্রবাস জীবনকে চিরতরে বরণ করে নব্বইয়ের একটা সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম আমেরিকা নামের নতুন এক দেশের অপরিচিত নগর নিউইয়র্কে। সে সময় নগরের প্রকৃতিতে চলছে শরতের আবাহন। মার্কিন ক্যালেন্ডারে যার নাম ফল সিজন। জীবনে প্রথম অনেক কিছু দেখার সঙ্গে বিস্ময়ে দেখলাম প্রকৃতির বৃক্ষ আর লতাগুল্ম এক ঋতুর আশ্চর্য স্পর্শ পেয়ে কি করে একটু একটু করে মেতে উঠেছে রঙের খেলায়। বাংলায় সময়টা তখন আশ্বিন মাসের। নীল আকাশে ভাসা সাদা মেঘের ভেলার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বনে বনান্তরে ফুটছে শরতের শুভ্র কাশ ফুল। আমার জন্ম শহরে এই সময় বেজে উঠতো ঢাকের বাদ্যি। সেটা কানে যেতেই লেখাপড়া মাথায় তুলে মন্দির প্রাঙ্গণে বন্ধুদের সঙ্গে ছুটতে ছুটতে যাওয়া। পরিবার ও জীবন তখন ধর্মের বারণ দিয়ে ছেঁটে দেয়নি বালিকা বয়সের সেই, খুশির ডানা মেলা। তারপর বিরহ না বোঝা একটা বয়সেই শরৎ ঋতু একাকার হয়ে গেল মাতামহের প্রিয় জগন্ময় মিত্রের সেই চল্লিশ দশকের অমর বিরহ গানের সঙ্গে ‘সাতটি বছর আগে আজি এ শারদ রাতে… তখন বাতাসে আঙিনার পাশে শেফালী পড়িছে ঝরে, কি জানি সহসা আঁখি দুটি তব কূলে কূলে গেল ভরে।’ সে গানের বাণী ও সুর হৃদয়ে আজও হয়ে রইল অক্ষয় বেদনা হয়ে। মনের মধ্যে উঁকি দেয় মহালয়ার দিনে ভোরের অন্ধকারেই নানা আকাশবাণীর রেডিওটা খুলতেন। দু’জনে একসঙ্গে শুনতাম বীরেন ভদ্রের সেই অসাধারণ স্ত্রোত্র পাঠ-
যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥
মন কেমন করা প্রবাস শুরুর ঘর বন্দী একদিনে সুহৃদ রেহানা ভাবী খুশির বাতাস ছড়িয়ে জানালেন- আজ বিকেলে আমরা সবাই পুজোয় যাচ্ছি, আপনারাও চলেন।
আমাদের নতুন জীবনে তিনি ও তার হাসব্যান্ড ড. সারয়ারুল হাসানের বাড়িতে তখন আমরা থাকছি। যারা দু’জন এই দেশ সম্পর্কে সকল জ্ঞানের আধার।
বেশ অবাক হয়ে বললাম,
-এখানেও পুজো হয় নাকি? দুর্গা মন্দির আছে এ শহরে?
তার কাছেই জানলাম মন্দির নেই, তবে কর্পাস কৃষ্টি নামে একটি ক্যাথলিক চার্চে নিউইয়র্কের বাঙালী হিন্দুরা অনেক দিন ধরে দুর্গাপূজা করে আসছে। পরে জেনেছি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত নিউ ইয়র্কের এই ঐতিহাসিক ক্যাথলিক চার্চ মর্নিং সাইড হাইটসে অবস্থিত। যীশু খ্রিস্টের সঙ্গে দুর্গা দেবীর এমন চমৎকার সহাবস্থান সত্যি চমৎকৃত না করে পারল না। কিন্তু কর্পাসের সেই অনুষ্ঠানে খুব একটা জাঁকজমক ছিল বলা যায় না। সেই প্রায় সাদামাটা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে এমন একজন বিশাল মাপের মানুষকে সপরিবারে দেখতে পাব কল্পনাতেও আসেনি। তিনি হলেন বাংলা তথা ভারতের প্রখ্যাত গীতিকার ও সংগীতকার সলিল চৌধুরী।
সলিল চৌধুরীকে সঙ্গীত জগতের মানুষেরা সম্বোধন করতেন ‘সলিল দা’ হিসেবে। ১৯৫০-এর দশকের মধ্য দিয়ে যার আবির্ভাব সেই সলিল চৌধুরী তখনও একই সঙ্গে একজন বিশাল মাপের সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার, গীতিকার, লেখক এবং কবি। বাংলা ছাড়াও হিন্দী এবং দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে কাজ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, অভূতপূর্বভাবে নানা শৈলীর জাদুকর তিনি। তিনি তখনও একাধারে বাজান বাঁশি, এস্রাজ, ভায়োলিন এবং পিয়ানো। বোম্বে ছবির তিনি অনেক বিখ্যাত গানের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন।
বিকেলে সবাই শাড়ি গয়না পরে সেজেগুজে যাওয়া হলো সেই পূজার অনুষ্ঠানে। বলা ভাল, সে সময় বাঙালীদের উৎসবে পশ্চিমা সালোয়ার কামিজ পোশাক পরায় একেবারেই চল ছিল না। দেশে গেলে সবাই শাড়িই আনতো কেবল। চার্চের ভেতরে একটা বড়সড় চত্বরে চেয়ার দিয়ে বসবার আয়োজন। সামনে সাজানো রয়েছে একটি স্টেজ। স্মরণ করিয়ে দেই তখনকার সময়ে নিউইয়র্ক শহর আজকালকার মতো বাংলাদেশের বাঙালীদের জনাকীর্ণ বসতি হিসেবে গড়ে ওঠেনি। বাংলা ভাষী কমিউনিটি বলতে গেলে খুব ছোটই ছিল এই নিউইয়র্ক নগরে। পশ্চিম বাংলার মানুষ ছিলেন আরও কম। কিন্তু দুই ধর্মের বাঙালীরা মিলে দর্শককুলের সমাবেশ বৃহৎ না হলেও মোটামুটি বেশ বড়ই হয়েছিল।
সেই বালিকা বেলার আগ্রহটা নিয়ে দরোজার এপার থেকে দেবী প্রতিমা দর্শনে গিয়ে দেখলাম একটা মাঝারি কক্ষে স্যুটকেসে প্যাক করে আনা যেতে পারে এমন সাইজের সামনে রয়েছেন একজন পূজারী। মহিলারা গলবস্ত্র হয়ে দেবী প্রণাম করছেন- কিছু পুরুষও আছেন।
বিকেল শেষ হবার আগে শুরু হলো গানবাজনা-স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে। সেসব সাঙ্গ হবার পর সেই নাম ঘোষিত হলো ওই যে যাকে প্রবাসে এসে এমন সাদাসিধেভাবে কোনদিন দেখতে পাব, তার গান শুনতে পাব কল্পনাই করিনি। সেদিন সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আরও আরও বাড়তি পাওনা ছিল তার স্ত্রী-প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সবিতা চৌধুরী ও কন্যা অন্তরা ও সঞ্চারী।
এরপর থেকে সদলবলে প্রায় বছরেই পূজা অনুষ্ঠানে যাওয়া হতো। কর্পাস চার্চ থেকে দেবী যখন গেলেন গুজরাটি সমাজ আশ্রমে তখনও যেতাম দলের সঙ্গে। কিন্তু সলিলদা সেসব পূজায় আর আসতে পারেননি। তাঁর প্রয়াণের পরপর ভারতীয় মানুষদের সুবিশাল আয়োজনে এসেছিলেন উপমহাদেশের সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী লতা মুঙ্গেশকর। নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ড নাসাউ কলজিয়ামে তাঁর সেই সঙ্গীতানুষ্ঠানে গিয়েছিলাম আমরা দুজন। লতাজি গানের শুরুতে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়েছিলেন তাঁর সলিলদাকে এবং গেয়েছিলেন সেই জনপ্রিয় বাংলা গান ‘.যারে …যারে উড়ে যারে পাখি।…’
বিদেশে এসে পরের বছরেই জ্ঞান অর্জন করলাম যে, দুর্গাপূজা কেবল বাঙালী হিন্দুদেরই উৎসব, সারা ভারতের অন্য হিন্দুদের জন্য নয়। আমেরিকায় অধিকাংশ অনাবাসী ভারতীয়দের সুবিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব হলো দেওয়ালি, বাংলাকরণ করলে বলা যাবে দীপাবলী। দেওয়ালীর নায়ক হচ্ছেন রঘুপতি রাঘব- যে রাঘবের সঙ্গে মধুসূদন দত্ত মেঘনাদ বধ কাব্যে পরিচয় করিয়েছিলেন এভাবেই- ‘আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?’ বারো বছর বনবাস সমাপ্ত করে যেদিন অযোধ্যার রাজা শ্রীরামচন্দ্র ফিরে এসেছিলেন নিজ রাজ্যে এবং প্রজারা মহানন্দে দীপ প্রজ্বালন করে পালন করেছিলেন যে আনন্দ উৎসব তারই স্মরণে এই দেওয়ালি।
এবার আবার ফিরে যাই নিউইয়র্কের বাঙালী পূজায়। নব্বই দশকের শেষের দিকে লটারি ভিসার মাধ্যমে ঘটে গেল অসংখ্য হিন্দু মুসলমানের অবাধ আগমন। কমিউনিটি প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে হৈহুল্লোড় নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু হলো বাংলাদেশী হিন্দুদের নিজস্ব দুর্গাপূজার আয়োজন। শুধু তাই নয় প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলাদেশী মন্দিরও। এই আয়োজনে শুরু থেকেই সংযোজিত হয়েছিল এক দারুণ মজার ব্যাপার। ম-প থেকে কিছু দূরে খোলামেলা জায়গায় সেখানে রান্নার আয়োজন হতে লাগল। বিশাল দুটো উনুন জ্বালিয়ে এক বড় হাঁড়িতে করে চাল ডাল সবজি মিলিয়ে ম ম করা গন্ধ ছাড়িয়ে রান্না করা হতে লাগল দারুণ সুস্বাদু খিচুড়ি এবং আর এক হাঁড়িতে টমেটো চাটনি। অদূরে সাজানো চেয়ার টেবিল একাধারে ডিস্পোজেবলে থালা বাটি চামচ। ধর্ম নির্বিশেষে নারীপুরুষ প্লেটে করে নিয়ে আসছে খিচুড়ি আর শেষ পাতে বাটিতে করে পায়েস। তবে কবুল করছি পায়েসটা তেমন অসাধারণ লাগত না। কারণ, এখনও রসনায় বিলাস হয়ে আছে যে ইন্দিরা মাসিমার সেই পায়েস।
ইদানীংকালে শুনতে পাই নিউইয়র্কে নাকি পূজার জাঁকজমক যেমন বেড়েছে তেমনি নাকি নেতৃত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে কলহ কোন্দলও। বহুদিন সেদিকে যাওয়া হয় না- জানি না এখনও সেই সুস্বাদু খিচুড়িটা রান্না করা হয় কিনা।
ভার্জিনিয়ার এক দুর্গাপূজায় যাওয়া হয়েছিল তাও সেটা হবে দশক দেড় আগে। অনেক আগের পরিকল্পনায় এক আত্মীয়ার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার মুখে শুনলাম আমরা পৌঁছুবার পরদিনই ওখানে বিজয়া দশমী। আত্মীয়া আমার ভাইয়ের শ্যালিকা। ভারতেশ্বরী প্রাক্তন ছাত্রী যার নাম জেসমিন জানাল- ওদের হোমসের মতোই পশ্চিমবঙ্গের এই পূজায় অংশগ্রহণ করে হিন্দু মুসলিম মিলিতভাবেই। ও বাংলাদেশের হলেও পশ্চিম বাংলার অংশ হয়েছে কারণ ওর বর সেখানকার বাঙালী। ওরা আমাদের জন্যও চাঁদা দিয়ে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে রেখেছে। রাতে ওদের বাড়ি পৌঁছার পর দেখলাম ওর বাচ্চারা বাবাকে নিয়ে পূজা অনুষ্ঠানের রিহার্সেলে গেছে, ছেলেরা বাংলা কবিতা পড়বে।
দুপুরের আগেই লাঞ্চ করে দুটো গাড়ি করে যাওয়া হলো পূজা প্রাঙ্গণে। ভার্জিনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন নারী পুরুষ সঙ্গে শিশু কিশোরের দল- বেশ বড় সড় গ্যাদারিং। বাচ্চাদের অনুষ্ঠান শুরু হলো বলে। সেটা শেষ হলে হবে স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশিত গান নাচ।
অনুসন্ধান করে দেবী দেখতে গেলাম। ওমা এ যে দেশের মতো দশ প্রহরীনী বড়সড় দুগ্গা প্রতিমা- এক্কেবারেই সেই ক্লাসিক কার্তিক গণেশ লক্ষ্মী অসুর নিয়ে সেই মহিষাসুর মর্দিনী দেবী।
আমি জিজ্ঞেস করলাম কর্মকর্তাদের একজনকে- এই প্রতিমা কি এখানে কোন কুমোর দিয়ে গড়েছেন। তিনি হাসলেন- দেবীকে কলকাতা থেকে জাহাজে করে আনা হয়েছে।
আপনারা কি প্রতিমাকে ভাসিয়ে দেবেন? উত্তরে তিনি বললেন নাহ, এদেশে তেমন ব্যবস্থা হয়নি। দেবী থাকবেন একজনের বেজমেন্টে পরের বছর এই দুর্গা দিয়েই পূজা হবে। ওদের অনুষ্ঠানের মাঝে মুড়ি চানাচুর ইত্যাদি স্নাক্স খাওয়া হলো। এরপর এলো আসল ভূরি ভোজনের পর্ব- প্যাকেটে পরিবেশিত হলো বিরিয়ানি। খেতে খেতে একটা মজার ঘোষণা কানে এলো আজকের পূজার এই ভোজ রান্না করেছেন এতদঞ্চলের বিখ্যাত শেফ সলিমুল্লাহ- এত বছরে সম্ভবত নামটা ভুল হয়নি।
একবার এই লেখাটায় বলেছিলাম ইন্দিরা মাসিমার পূজার পায়েসের কথা। সেটা ছিল কলেজ জীবনে বন্ধু ইরার বাড়িতে আমাদের বন্ধুদের নেমনতন্নে। আমি, কামরুন আর বিউটি সঙ্গে কারও কারও ভাই বোন মিলে সদলবলে। ইরার এই অহিন্দু বন্ধুদের জন্য টেবিলে সাজানো রাশি রাশি নাড়ু, বাটিতে পায়েস। সেই পায়েস খাবার জন্য মাসিমা ভাজছেন গরম গরম ফুলকো লুচি। ঠা-া হলে লুচির মজা মাটি যে! সেসব আসছে আর সাবাড় হচ্ছে- দুরন্ত মেয়েদের খাবার ধরনে কুলিয়ে ওঠা দায়।
লুচি আনবার জন্য রান্না ঘরের দরোজায় দাঁড়াই- মাসিমা !
-আয় ভেতরে এসে ভাজাগুলো নিয়ে যা!
-বাহ্ আমি রান্না ঘরে ঢুকলে আপনার জাত যাবে না?
-তুই আমার মেয়ে। মেয়ে রান্না ঘরে ঢুকলে যে জাত চলে যায় সে জাতের দরকার নেই।
এমনি ছিল সেসব দিনের দিনকাল। সাত নয় বহু বছর পরে আজও যখন আসে বিজয়া দশমী তখনও ব্রাহ্মণ কন্যা ইন্দিরা মাসিমা ফিরে ফিরে হৃদয় পটে আসেন এক অজানা লোক থেকে।
লেখক : নিউইয়র্ক প্রবাসী