মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে ফারুক, আমিনুলের গলার কাঁটা মজিবুর
- Oct 14, 2018
রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলা নিয়ে রাজশাহী-১ আসন গঠিত। এটি জাতীয় সংসদের ৫২ নম্বর আসন। এ দুই উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে আসনটির বিন্যাস।
বর্তমানে সেখানকার সংসদ সদস্য (এমপি) রয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকেই। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-১ আসনে বিএনপির প্রার্থীকে ১৭ হাজার ৩৩৬ ভোটে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী। পরেরবার বিএনপি ভোট বর্জন করায় সংসদে যেতে তাকে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়নি।
এবারও এ আসন থেকে তার মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত বলে গুঞ্জন রয়েছে। তবে এরপরও সেখান থেকে দলের সাত নেতা মনোনয়নের দৌড়ে মাঠে থাকার চেষ্টা করছেন। নেতৃত্ব ডিঙ্গিয়ে কালের পরিক্রমায় ওপরে উঠে আসা এ নেতাদের দাবি, তাদের মধ্যে একজনকে মনোনয়ন দিতে হবে।
অবশ্য এ আসনটি থেকে স্বাধীনতার পর প্রতিটি বড় দলের মনোনীত প্রার্থীরাই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের মন্ত্রী জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান।
তার ভাগ্নে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য। আগের মেয়াদে একবার শিল্প প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন এই তিনি।
তবে প্রথম ও সর্বশেষ সংসদে আওয়ামী লীগের এমপিরা এই আসন থেকে প্রতিনিধিত্ব করলেও নানা কারণে এখানে অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করছে বিএনপি।
উল্লেখযোগ্য ভোট রয়েছে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত দল জামায়াতে ইসলামীরও। আসছে একাদশ সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হলে সেক্ষেত্রে এই আসনে বিএনপি আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাবে বলেও ধারণা করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
আর স্থানীয় বিএনপি নেতারা মনে করেন, দলীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক মন্ত্রী আমিনুল হকের বিকল্প নেই এখানে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত আমির মজিবুর রহমান একসময় এখানে এমপি ছিলেন। তাই এবারের নির্বাচনে তাকেই জোটের প্রার্থী হিসেবে পেতে তৎপর জামায়াত।
তার জানান দিতে মজিবুর রহমানের পক্ষে এলাকায় এবার ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টারও সাঁটানো হয়েছিল।
এদিকে পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৬ সালের আগ পর্যন্ত রাজশাহীর গোদাগাড়ী-তানোর আসনটি ঘাঁটি ছিল আওয়ামী লীগের। প্রথম জাতীয় সংসদের মতো দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনেও আসনটি ছিল আওয়ামী লীগের দখলে।
১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে এখানে এমপি নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মোহসীন।
তবে ১৯৮৬ সালের ৭ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের তৃতীয় নির্বাচনে আসনটি জামায়াতে ইসলামীর কব্জায় চলে যায়। সেবার এমপি নির্বাচিত হন জামায়াত নেতা অধ্যাপক মজিবুর রহমান; যিনি বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত আমীর।
এরপর ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ৪র্থ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ দুরুল হুদা এই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরপর ১৯৯১ সাল থেকে পাল্টে যায় এখানকার রাজনৈতিক দৃশ্যপট। ওই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংস্থাপন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে ঠাঁই পান খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায়।
সে সময় তার নেতৃত্বে গোদাগাড়ী ও তানোর উপজেলার প্রতিটি এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। দাবি করা হয়, বিদ্যুৎ, ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠমো নির্মাণ ছাড়াও যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে তার সময়ে।
ব্যারিস্টার আমিনুল হক ১৯৯১ সাল থেকে ২০০১ সালের পয়লা অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিজয়ী হন। ফলে একটানা তিনবার সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি।
খালেদা জিয়ার সরকারের দুই মেয়াদেই তিনি প্রথমে প্রতিমন্ত্রী এবং পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ফারুক চৌধুরী ২০০১ সালের নির্বাচনে আমিনুল হকের কাছে হেরে যান।
তবে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমিনুলের বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা হয়। এতে গ্রেফতার এড়াতে তিনি আত্মগোপন করেন। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে না পারায় বিএনপির প্রার্থী হয়েছিলেন তার বড় ভাই সাবেক পুলিশপ্রধান এনামুল হক।
তিনি ফারুক চৌধুরীর কাছে হেরে যান। তবে আমিনুল হক ছাড়াও বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত সচিব জহুরুল ইসলাম, জেলা বিএনপির সাবেক যুব বিষয়ক সম্পাদক সাজেদুর রহমান খান মার্কনী ও যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ক্যালিফোর্নিয়া বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন।
আওয়ামী লীগের প্রথম দফার মেয়াদের শেষ পর্যায়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে শিল্প প্রতিমন্ত্রী হন ফারুক চৌধুরী। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন তিনি।
এবারের নির্বাচনে আসনটি থেকে একই দলের মনোনয়নপ্রত্যশী রয়েছেন আরও সাতজন। তারা হলেন-তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও মুন্ডুমালার পৌরমেয়র গোলাম রাব্বানী, জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি মতিউর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বদরুজ্জামান ও মকবুল হোসেন খান, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য আতাউর রহমান খান, জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক মনিরুল ইসলাম ও জেলা কৃষক লীগের সহ-সভাপতি আবদুল ওহাব।
এই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী গোলাম রাব্বানী বাংলানিউজকে বলেন, নেত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক সব সময়ই বলছেন- তৃণমূলের সমর্থন যার পক্ষে, তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। এটাই যদি হয়, তাহলে আমার নামটা উঠে আসবে। তাই আমি এই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী।
‘তবে সিদ্ধান্ত যাই হোক, হাইকমান্ডের নির্দেশ মেনে চলবো। সেখান থেকে যা বলা হবে সেভাবেই নৌকার পক্ষে কাজ করবো।’
এই আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি মতিউর রহমান জানান, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে তাকে চাকরিচ্যুত করে। এরপর থেকে থেকে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। এ কথা ঠিক যে, বিগত দুটি নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি।
তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন হওয়ায় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
তবে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বদিউজ্জামান ও তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আলম মামুন বলেন, এই আসন থেকে বর্তমান এমপি ফারুক চৌধুরী এবারও দলীয় মনোনয়ন পাবেন- এ বিষয়আমরা শতভাগ আশাবাদী। আর তার নেতৃত্বেই একাট্টা হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই আসনটি আবারও সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দেবেন।
সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, এই আসনটি পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছি। যা এখনও সমুন্নত রয়েছে।
‘আমার দায়িত্ব এখানে আওয়ামী লীগকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী রাখা। সেটাই আমি পালন করে যাচ্ছি। এখন নেত্রী মনে করলে মনোনয়ন দেবেন। বড় দল তাই অনেকের অনেক রকম প্রত্যাশা থাকতেই পারে। তবে নেত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
যোগাযোগ করলে জেলা জামায়াতের মুখপাত্র অ্যাডভোকেট আবু মোহাম্মদ সেলিম বলেন, রাজশাহী-১ আসনটি একসময় আমাদের ছিল। এবারও আমরা এখানে মনোনয়ন চাইবো এবং আসনটি পাবো বলে আশাবাদী।
তবে এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর তানোর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও তানোর পৌরসভার মেয়র মিজানুর রহমান বলেন, জামায়াত এ আসনে একবার এমপি থাকলেও ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ১৯৯১ সাল থেকে এ আসনটি বিএনপির দুর্গ। ফলে অন্য দলকে আসনটি ছাড় দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এবারও তাদের প্রার্থীকে মনোনয়নের জন্য তৃণমূলের সুপারিশ রয়েছে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য রাজশাহী-১ আসনের মোট ভোটার ৫ লাখ ৭৬ হাজার ২৫০ জন। এর মধ্যে গোদাগাড়ীতে ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০ এবং তানোরে ২ লাখ ১৯ হাজার ৮৫০ জন। গোদাগাড়ী উপজেলার মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩৮ হাজার ৭৭ ও নারী ১ লাখ ১৮ হাজার ৩২৩ জন।
আর তানোরে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৫১ জন পুরুষ ও ৭৪ হাজার ৪৯৯ জন নারী ভোটার রয়েছেন।