রাজশাহীতে ঐক্যফ্রন্টের জনসভায় বিএনপির মূল দাবি খালেদার মুক্তি
- Nov 09, 2018
- ড. কামাল যাননি ॥ আন্দোলনের ঘোষণা না থাকায় কর্মীরা হতাশ, ঐক্য অটুট রাখার আহ্বান অন্য নেতাদের
স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ রাজশাহীতে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশে কর্মীদের প্রতি নানা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে এলোমেলো বক্তব্য রেখেছেন নেতৃবৃন্দ। কোন দিকনির্দেশনা নয়, আন্দোলনের ঘোষণাও আসেনি এ সমাবেশে। আগে থেকে নানা উত্তপ্ত বক্তব্য ছড়িয়ে রাজশাহী থেকেই সরকার পতনের আন্দোলনের ঘোষণা আসবে এমন আভাস দেয়া হলেও কার্যত কোন নির্দেশনা না পেয়ে হতাশ হয়েছেন কর্মীরা।
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান ড. কামালের অনুপস্থিতিতেই শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সমাবেশে বিএনপি নেতাদের মূল দাবি উঠে আসে খালেদা জিয়ার মুক্তি। আর অন্য নেতাদের আহ্বান ঐক্যফ্রন্ট অটুট রাখার।
সমাবেশে ড. কামালের অনুপস্থিতিতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সময় খুব সংকীর্ণ, সংকট আরও ভয়াবহ। আজকে প্রশ্ন বাংলাদেশে গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না। প্রশ্ন বাংলাদেশ স্বাধীন স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে পারবে কি পারবে না। আমাদের কথা বলার অধিকার, আমাদের ভোট দেয়ার অধিকার থাকবে কি থাকবে না, সংগঠন করার অধিকার থাকবে কি থাকবে না, মৌলিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুক্রবার বিকেলে রাজশাহীর মাদ্রাসা মাঠে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আয়োজিত রাজশাহী বিভাগীয় জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা ঐক্য করেছি, দেশনেত্রী খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে মিটিংয়ে বলেছিলেন, আমি হিংসা চাই না, শান্তি চাই। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করবেন। সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা সংলাপে দাবি দিয়ে এসেছি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। দেশনেত্রীকে মুক্তি দিতে হবে।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা জানি আপনারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দেশে গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠার জন্যেই আপনাদের এই ত্যাগ। মামলা হামলায় আপনারা জর্জরিত। এখানে একজনও নেই যার বিরুদ্ধে মামলা নেই।
তিনি বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল নেতাকর্মীর মুক্তির দাবি জানিয়ে বলেন, তার মুক্তি দিলেই আমরা নির্বাচনে যাব, নইলে নির্বাচনে যাব না। দেশনেত্রীকে মুক্তি দিয়ে তাকে নির্বাচনের মাঠে কাজ করতে দিতে হবে। অন্যথায় কোন তফসিল গ্রহণযোগ্য বলেও বলেন ফখরুল।
তিনি বলেন, এই রাজশাহী থেকে অনেকে রক্ত দিয়ে বিদায় নিয়েছে। তাদের রক্ত বৃথা যেতে দেয়া যাবে না। আমরা জানি রাস্তায় আপনাদের বাধা দিয়েছে। কিন্তু সব বাধা উপেক্ষা করে দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য গণতন্ত্রের জন্য এখানে এসেছেন। তিনি বলেন, সবশেষে জানতে চাই আপনারা কি দেশনেত্রীর মুক্তি চান? তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনতে চান, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা চান, তাহলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাজশাহীর সমন্বয়ক সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর সভাপতিত্বে অনুুষ্ঠিত জনসভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন, জেএসডির সভাপতি আসম আব্দুর রব, এলডিপির সভাপতি কর্নেল অলি আহমেদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ড. আব্দুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যর আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, উপদেষ্টা এসএম আকরাম, এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, মোঃ আমিনুল হক, মোঃ শাহজাহান, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার।
সমাবেশে ঐক্যফ্রন্টের সাত দফায় প্রধানমন্ত্রী বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষ কেন এক মঞ্চে? দেশের ঘটনা কী? আজকে গণতন্ত্র নিখোঁজ।
জনসভায় উপস্থিত জনতার উদ্দেশে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আপনারা কি বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে? আজকে ‘আপোসহীন নেত্রী’ কারাগারে। তাকে কারাগারে রেখে আপনারা নির্বাচনে যাবেন? সাত দফা না মানলে আপনারা নির্বাচনে যাবেন?
তিনি আরও বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার অধীনে নির্বাচন, শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচন, সেই নির্বাচনে আপনারা ভোট দিতে পারবেন? শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গেলে শেখ হাসিনা আজীবন প্রধানমন্ত্রী আর খালেদা জিয়া আজীবন জেলখানায়। তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন না।
তিনি বলেন, জাতীয় নেতৃবৃন্দকে বলব জনগণের মনের ভাব বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন। যদি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন তাহলে জনগণ আপনাদের ক্ষমা করবে না। শেখ হাসিনাকে নামান, নুরুল হুদাকে নামান, নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। দেশে একদিন অবশ্যই গণতন্ত্রের উৎসবের ভোট হবে তবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রেখে নয়।
সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আর এই সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আমরা গত ১০ বছরে ভোটের অধিকার হারিয়েছি। আইনের সামনে দাঁড়িয়ে সমান অধিকার হারিয়েছি। আমরা এগুলো ফেরত চেয়েছিলাম, আমরা সংলাপে বসেছিলাম। কিন্তু সফল হয়নি। কারণ, সরকার ক্ষমতা ছাড়তে চায় না।
তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে, আমরা বলেছিলাম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু তারা মানেননি। ৭ নবেম্বর আমরা সবশেষ সংলাপে বসেছিলাম। তারা একটি কথা দিয়েছিলেন যে, আমরা নির্বিঘ্নে সভা-সমিতি করতে পারব। কিন্তু সেই কথাও রাখেননি। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেই কথার বরখেলাপ করেছেন।
মওদুদ আহমদ বলেন, দুই হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছেন। আপনারা বলেছিলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে নির্জন কারাগারে পাঠিয়ে দিলেন। আমরা দেখলাম আপনারা কথা দিয়ে কথা রাখেন না। আমরা জানতাম নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হলে সবাই স্বাধীনভাবে কর্মসূচী পালন করতে পারবে। কিন্তু দেখলাম এই জনসভায় আপনারা বাধা দিলেন।
তিনি আরও বলেন, এই দলীয় সরকারের অধীনে কখনই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। যতদিন এই সরকার ক্ষমতায় থাকবে ততদিন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারবে না। তবে এবার আমরা তাদের বিনা চ্যালেঞ্জে আর ক্ষমতায় যেতে দেব না। আমরা গণজোয়ার তৈরি করব, সেই গণজোয়ারে নৌকা ভেসে যাবে।
সমাবেশে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমি বিএনপির সভায় আসিনি, কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের সভায় এসেছি। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে চাইলে ঐক্যফ্রন্ট অটুট রাখতে হবে। কাদের সিদ্দিকী বলেন, এর আগে শেখ হাসিনাকে বলেছিলাম আলোচনায় বসুন, বসেননি। এবার আলোচনায় বসেছেন। যেদিন আলোচনায় বসেছেন সেদিনই আপনাদের বিজয় হয়েছে। আপনারা কি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় চান? বাংলাদেশের রাজনীতি মানেই খালেদা জিয়া, তাকে বন্দী রাখা সম্ভব নয়। টাঙ্গাইল থেকে সড়কপথে এসেছি, রাস্তায় রাস্তায় বাধা এসেছে। আমাকেও ফেরাতে পারেনি। এই মাঠের মানুষদেরও পারেনি।
কর্নেল অলি আহমেদ বলেন, নির্বাচন হবে কি না, নির্বাচনে যাব কি না সেটা বলতে পারি না। তবে, একটা কথা বলতে পারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য মাঠে থাকব। জনসভায় তিনি তরুণদের উদ্দেশে বলেন, আমরা যেভাবে জীবন দিতে গিয়েছিলাম, সেভাবে জীবন দিতে বলব না। তবে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য অন্তত রাস্তায় থাকুন।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ, তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। চিকিৎসা ছাড়াই তাকে জোড় করে আবার কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার কি দোষ ছিল? তিনি দেশের জনগণের ভোটাধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছিলেন। সেজন্য এ সরকার তাকে কারাগারে রেখেছে। কারণ এ সরকার জনগণকে ভয় পায়। তার ৫ জানুয়ারি প্রহসন করে গায়ের জোরে ক্ষমতায় আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এ সদস্য আরও বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতিকে কিভাবে দেশ ত্যাগ বাধ্য করা হয়েছে তা আপনারা দেখেছেন। সেই প্রধান বিচারপতি লিখেছে, যে দেশের প্রধান বিচারপতি ন্যায়বিচার পায় না, সে দেশের জনগণ কিভাবে ন্যায়বিচার পাবে। আপনারা কি আগামী নির্বাচন খালেদা জিয়াকে ছাড়া হতে দেবেন? ৫ জানুয়ারি নির্বাচন খালেদা জিয়া বয়কট করার কারণে নির্বাচন হয়নি। এবারও খালেদা জিয়াকে ছাড়া জনগণ কোন নির্বাচন হতে দেবে না।
তিনি বলেন, সাত দফার আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, প্রশাসনকে বলতে চাই, আপনারা বাধা দিয়েছেন। কিন্তু রাখতে পারেননি। জনগণের জোয়ার বাধা দিয়ে রাখা যায় না। আওয়ামী লীগের সময় শেষ। জনগণের টাকায় আপনাদের বেতন হয়। আপনারা জনগণের পাশে দাঁড়ান। যদি না দাঁড়ান, তাহলে জনগণ একদিন আপনাদের কাছে তার কৈফিয়ত দাবি করবে।
সমাবেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ঐক্যফ্রন্ট নেতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সরকারের ভিত নড়ে গেছে। তারা পালাবার পথ খুঁজছে। আপনারা মাঠে থাকেন। আপনাদের বিজয় সুনিশ্চিত। জাফরুল্লাহ বলেন, এবার আপনারা জয়ী হবেন, জয়ী হলে কি হবে? কৃষক-শ্রমিকদের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। কৃষকের পণ্যের মূল্য নেই, শ্রমিকের শ্রমের মূল্য নেই। এসব প্রতিষ্ঠিত হবে।