বাংলাদেশের বদলে যাওয়া: দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ, বিশ্বের বিস্ময়
- Sep 10, 2018
দুই শতাব্দীর বৃটিশ গোলামি, দুই যুগ পাকিস্তানের অত্যাচার ঘুচিয়ে ‘৭১ এর শেষে পড়ন্ত বিকেলে ডুবন্ত সূর্যের সমান্তরালে জন্ম নিল ছোট্ট একটি স্বাধীন ভূখণ্ড। মায়ের ভাষার নামে দেশটির নাম ‘বাংলাদেশ’। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর কেমন আছে শেখ মুজিবের অঙ্গুলি নির্দেশে লাখো মানুষের রক্তঝরা লাল সবুজের দেশটি?
বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে, ভারত বেষ্টিত দক্ষিণ এশিয়ার নবীনতম এই দেশটির যখন জন্ম হয় তখন আমেরিকা আমাদের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দেয়। পরিসংখ্যান বলছে- বর্তমান বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ, বিশ্বের বিস্ময়। আলাদিনের রূপকথা বা জাদুর দৈত্য নয়, মানুষের উদ্যম, স্পৃহা নিংড়ানো পরিশ্রম, একজন দিকদর্শী নেত্রী সম্ভব করেছে এই কল্পযাত্রা।
চলার পথটা খুব সুগম ছিল না। আইলা কিংবা সিডর লণ্ডভণ্ড করেছিল উপকূল, খরা, অনাবৃষ্টি কপালে ভাঁজ ফেলেছিল কৃষকের, অশান্তি দানা বেঁধেছিল পাহাড়ে, বাড়তি মানুষের স্রোত স্থবির করেছিল রাজধানী- কিন্তু থামেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তান- যারা আমাদের গণনার মধ্যে ধরত না, তারা এখন স্বপ্ন দেখে ‘অন্তত বাংলাদেশ’ হবার।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন ও আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডে বাংলাদেশ ‘উন্নয়ন বিস্ময়’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর্থসামাজিক বেশিরভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার জায়ান্টদের। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় সক্ষমতা- তিন সূচকে ধারাবাহিক সাফল্য অর্জন করায় জাতিসংঘ মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশকে।
বাংলাদেশের পণ্য উৎপাদনখাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেট ডিক্সন বলেন, ‘ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝামাঝি। এই সুবিধা বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের গতি অনেক বাড়িয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে’। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ সঞ্জয় কাঠুরিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের পণ্য উৎপাদনখাত দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো যখন বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন করে বাজার খুঁজবে, তখন তাদের সামনে পূর্ব ও পশ্চিম- দুই দিকই উন্মুক্ত থাকবে’।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের করা ‘দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ রিপোর্টে ২৫ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ৪৭তম৷ যুক্তরাষ্ট্রও বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ নানা বিশ্বসংস্থা বাংলাদেশের উন্নয়নে প্রশংসা করছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে আইএমএফ-এর মূল্যায়ন, যেভাবে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য দূর এবং বৈষম্য কমানোকে সংযুক্ত করেছে, তা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বলছে- ৬ শতাংশ বা এর বেশি হারে অব্যাহত প্রবৃদ্ধি অর্জন গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে। মূলত ৮০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো আয়, তৈরি পোশাক খাতের প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এবং কৃষির সবুজ বিপ্লব বা এক জমিতে দুই ফসল দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ বা সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মুঠোফোনের একক বা ইউনিক ব্যবহারকারী। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একক মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা গড়ে ৫০ শতাংশ। আর ভারতে একক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ওই দেশটির জনসংখ্যার ৪৮ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে একক মুঠোফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার গড় থেকে বেশি। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ভারতে মোট জনগোষ্ঠীর ৩৫ শতাংশ আর দক্ষিণ এশিয়ায় গড়ে ৩৪ শতাংশ মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। মুঠোফোন অপারেটরদের বৈশ্বিক সংগঠন জিএসএমএর ‘ইকোনমিক ইমপ্যাক্ট: বাংলাদেশ মোবাইল ইকোনমি’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ থেকেও সাইবার নিরাপত্তার এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিশ্বের পুরোনো চিকিৎসা বিষয়ক সাময়িকী ‘দ্য ল্যানসেটে’ প্রকাশিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা সূচকে বাংলাদেশ রয়েছে ১৩৩তম অবস্থানে। গত বছর বাংলাদেশের এ অবস্থান ছিলো ১৩৯তম।
প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ এবং ভারতের সাফল্য প্রায় সমান। বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যেখানে ৪৯ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশে দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৫০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ৫২ শতাংশই ছাত্রী। বাংলাদেশ অবিচলভাবে শিক্ষায় অভিগম্যতা বাড়িয়েছে, যার ফলে প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হার ৯১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০০ শতাংশের উন্নীত হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তির হার ৫২ থেকে ৬২ শতাংশ হয়েছে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ভর্তির হার ৩৩ থেকে ৪৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (ফাও) তথ্য অনুসারে, ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অবস্থান অষ্টম। আর মোট ফল উৎপাদনে বিশ্বে ২৮তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় কম জমিতে অনেক বেশি ফসল ফলানোর পারদর্শিতা দেখিয়েছেন বাংলার কৃষকরা।
বাংলাদেশে বর্তমানে সাড়ে ৬শ’ কারখানা পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে স্বীকৃত পাওয়ার তালিকায় গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এখন বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রীন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) তালিকায় লিড সনদ পাওয়া সেরা গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে বাংলাদেশ এগিয়ে। ২০১৭ সালেই স্যানিটেশনে শতভাগ সফলতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ খোলা জায়গায় পায়খানার হার শূণ্যে নামিয়ে এনেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশ এই অবস্থানের ধারেকাছেও নেই।
ভৌত অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ও বন্দরের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে তিনগুণ হয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। পায়রা ও কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে আরও দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, অনির্বাণ আগামীর লক্ষ্যে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশকে দরিদ্র্য রাষ্ট্র বলে উপহাসকারীরা আজ অবাক বিস্ময়ে দেখে কিভাবে বাংলাদেশ পুঁজিবাদী সিস্টেমের বাইরে গিয়ে কোন স্বার্থ ছাড়াই লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গ্যা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। সীমান্ত খুলে দিয়ে মাদার অব হিউম্যানিটি প্রমাণ করেছেন কেন তিনি শান্তির বৃক্ষ।
বাংলাদেশ মানে অমিত সম্ভাবনা, বাংলাদেশ মানে উদার অসাম্প্রদায়িকতা। আমাদের জনবল আছে, আমাদের নেতৃত্ব আছে, আমাদের মেধা আছে, আমরা পরিশ্রমী, আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি- আমরা কেন থামব? আমাদের ঈর্ষণীয় ইতিহাস এবং উদ্যমী বর্তমান পথ দেখাবে সামনের পথচলা।