রাজশাহী নগর ভবন নতুন মেয়রের অপেক্ষায়
- Oct 03, 2018
আলোকিত ডেস্ক : গত ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) বিপুল ভোটে নির্বাচিত মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের অপেক্ষায় এখন রাজশাহী নগর ভবন। তাকে বরণের অপেক্ষায় চেয়ে আছেন রাজশাহীবাসীও। ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিয়েছে মেয়র লিটন ও রাসিকের কাউন্সিলরা। আগামী ১০ অক্টোবর তিনি নগর ভবনে গিয়ে মেয়রের চেয়ারে বসবেন বলে জানা গেছে। নগর ভবনে এরইমধ্যে মেয়র লিটনকে বরণের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
এবার মেয়র হিসেবে পাহাড় সমান চ্যালেঞ্জ রয়েছে লিটনের জন্য। আর এই চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে আগামী মাসে নগর পিতার দায়িত্ব নেবেন তিনি। ভোটের আগে নগরবাসীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন লিটনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০০৮ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে ব্যাপক উন্নয়ন করে নগরীর চেহারা পাল্টে দেন তিনি। তবে নানান কারণে ২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী বুলবুুলের কাছে হেরে যান তিনি। মনে করা হয়, উন্নয়ন ব্যর্থতায় এবার ভরাডুবি হয়েছে বুলবুলের। আর রাজশাহী বদলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জন রায় নিজের পক্ষে নিয়েছেন লিটন। এরইমধ্যে দায়িত্ব গ্রহণের আগেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন শুরু করেছেন তিনি। এরই অংশ হিসেবে গত সোমবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজশাহীতে বাণিজ্যিকখাতে গ্যাস সংযোগ দেয়ার ফরম বিতরণের মাধ্যমে শিল্প-বাণিজ্যিক ও আবাসিক ক্ষেত্রে গ্যাস সংযোগ দেয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন শুরু করেন তিনি।
এছাড়া আবাসিক গৃহে গ্যাস সংযোগ নিতে যে ২১ হাজার জন আবেদন করেছেন, তাদের গ্যাস দেয়া কাজ শীঘ্রই শুরু হবে বলেও জানিয়েছেন মেয়র। মেয়র লিটন বলেন, ২০০৫/২০০৬ সালে আমরা রাজশাহীতে গ্যাস সংযোগ পেতাম। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের একজন রাজপুত্রের কারণে তখন রাজশাহীকে বাদ দিয়ে বগুড়ায় গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়। এটি আমাদের জন্য অনেক কষ্টের ছিল। তবে পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি করে রাজশাহীতে গ্যাস সংযোগ নিয়ে আসি। ২০১৩ সালের জুন মাসে আমরা প্রথম আবাসিকে গ্যাস সংযোগ পাই।
তিনি বলেন, রাজশাহীতে শিল্প ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে গ্যাস সংযোগ বেশি দরকার। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণের আগেই বাণিজ্যিক খাতের জন্য গ্যাস সংযোগের ফরম বিতরণ করা হয়েছে। এই সংযোগ দেয়ার কাজ অব্যাহত থাকবে। আর আবাসিক গৃহে রাজশাহীতে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৩৬৪ জনকে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছে। আবাসিক গৃহে যে ২১ হাজার আবেদন রয়েছে, তাদেরও শীঘ্রই সংযোগ দেয়া হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার লিটনের সামনে চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম দেনার দায়ে প্রায় দেওলিয়া সিটি কর্পোরেশনে আর্থিক গতি ফিরিয়ে আনা। নগরকে ক্লিন সিটি করাও অন্যতম চ্যালেঞ্জ লিটনের। এছাড়াও মেয়র হিসেবে লিটনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কর্মসংস্থান। গেল নির্বাচনী ইশতেহারে নগরবাসীর কর্মসংস্থানে জোর দিয়েছিলেন লিটন। বিশেষ করে গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে গার্মেন্টস শিল্প স্থাপন, অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক দ্রুত বাস্তবায়ন করে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
তাছাড়া রেশম কারখানা ও টেক্সটাইল মিল পুরোদমে চালু, রাজশাহী জুটমিল সংস্কার, কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন এবং কুটির শিল্পের সম্প্রসারণের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতিও রয়েছে তার। তবে এ সবকিছুই নির্ভর করছে কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তের ওপর। এখানে মেয়র হিসেবে লিটন কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবেন সেটিই দেখার বিষয়।
লিটনের সামনে আরেক বড় চ্যালেঞ্জ রাজশাহী নগরীর উন্নয়ন। তিনি তার নির্বাচনী ইশতেহারে প্রাধান্য দিয়েছিলেন এই ইস্যু। নগরীর চারদিকে রিং রোড ও লেক নির্মাণ, নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ফ্লাইওভার এবং ওভারপাশ নির্মাণ, পর্যটনবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে লিটনের। এছাড়াও নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে খেলার মাঠ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং মাতৃসদন স্থাপনের অঙ্গীকার করেন লিটন। রাজশাহী শিশু হাসপাতাল ও প্রস্তাবিত পানি শোধনাগার প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চান। বস্তিবাসীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে চান তিনি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নিম্নআয়ের মানুষদের বসবাসের জন্য বহুতল ফ্লাটবাড়ি নির্মাণ করে সহজ কিস্তিতে মালিকানা দেয়ার। মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, আলেম ও সাংবাদিকদের জন্য আলাদা আবাসন এলাকাও গড়ে তুলতে চান।
শিক্ষানগরী খ্যাত রাজশাহীর শিক্ষাখাতের উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে লিটনের। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড সার্ভে ইনস্টিটিউটকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তর, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, নতুন একাধিক বালক ও বালিকা স্কুল-কলেজ নির্মাণ, পূর্ণাঙ্গ সঙ্গীত, ইউনানী এবং আয়ুর্বেদিক মহাবিদ্যালয় স্থাপন ও বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে চান।
নগরীর যোগাযোগ ক্ষেত্রেও তার পরিকল্পনা গগণচুম্বি। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাজশাহী-ঢাকা বিরতিহীন ট্র্রেন এবং রাজশাহী-কলকাতা ট্রেন ও উড়োজাহাজ চালুর। রাজশাহী বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে চান তিনি। এছাড়া শুকিয়ে যাওয়া পদ্মায় ড্রেজিং করে নৌ-চলাচল এবং নতুন নতুন সড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি রয়েছে তার।
নগর বিশ্লেষকরা বলছেন, লিটন তার যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনায় নিয়েছেন তাতে বিপুল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হাজার হাজার মানুষকে গৃহচ্যুত হবে। কৃষিজমি হারিয়ে বেকার হতে হবে অনেককেই। এসব প্রকল্প বাস্তয়নে গড়ে উঠতে পারে ঠিকাদার সিন্ডিকেট। হতে পারে টেন্ডারবাজিও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৩ সালে তৎকালীন মেয়র লিটনের পরাজয়ের প্রধান কারণই ছিল তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব। কিন্তু এবার সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তাকে জেতাতে মরিয়া হয়ে মাঠে ছিলেন। এর ফলও মিলেছে। মেয়রের চেয়ারে বসার পর লিটনের প্রতি নেতাকর্মীদের আবদার বাড়বে এবার। কিন্তু রাজশাহীর পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ খায়রুজ্জামান লিটন এবার সেই পথে হাটতে চান না। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে চান। লিটন বলেন, তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন যোগ্য। যে কোন মূল্য নগরবাসীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চান তিনি।
তিনি আরও বলেন, নগরভবন নাগরিক সেবার প্রতিষ্ঠান। নগরবাসীর জন্য নগরভবনের দরজা সবসময় খোলা থাকবে। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হলেও নগরবাসীর মেয়র। তিনি নাগরিক হিসেবে সবাইকে সমান সুযোগ দিতে চান। নগরীর উন্নয়ন সঠিক পথে এগিয়ে নিতে সবার সর্বাত্মক সহায়তা চান তিনি।
লিটন বলেন, বর্তমান সরকার উন্নয়নের সরকার। নির্বাচতি হবার পরপরই তিনি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। সেখানে রাজশাহীবাসীকে দেয়া নানান প্রতিশ্রুতির কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানান লিটন। পরে প্রধানমন্ত্রী সকল ক্ষেত্রে রাজশাহীর উন্নয়নে সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেন। আগামী ৫ বছরে রাজশাহীকে এশিয়ার সেরা শহরে পরিণত করার আশাবাদ জানান লিটন।
এদিকে মেয়র হিসেবে শপথ নেয়ার পর থেকেই লিটনকে বরণ করতে অপেক্ষায় রয়েছেন নগরবাসী। রাজশাহী নগর ভবনেও জেগে উঠেছে প্রাণ। গত ৫ বছর ঝিমিয়ে পড়া রাজশাহী নগর ভবনে এখন প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। রাসিকের কর্মকর্তা, কর্মচারীরাও অপেক্ষায় রয়েছে নগর পিতার জন্য। এরই মধ্যে নতুন করে সাজানো হয়েছে নগর ভবন। মেয়র লিটন প্রথমদিন নগর ভবনে প্রবেশ করলে তাকে ব্যাপক সংবর্ধনার প্রস্তুতিও নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন।