• Thursday, November 21, 2024

যেভাবে সেদিন রক্ষা পান শেখ হাসিনা

  • Oct 10, 2018

Share With

আলোকিত ডেস্ক: বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বিকেলে সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি মিছিল শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড হামলার শিকার হন শেখ হাসিনা। অস্থায়ী ট্রাকে বানানো মঞ্চে তার বক্তৃতার একেবারে শেষ পর্যায়ে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরিত হতে থাকে আশপাশে।

আকস্মিক সেই হামলার মুখে প্রাণ তুচ্ছ করে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী আর দলীয় নেতা-কর্মীরা মানবঢাল তৈরি করেন। তাদের সেই দুঃসাহসিক চেষ্টায় সেদিন বেঁচে যায় বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রাণ।

আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। ওই হামলার পর তাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে বুলেট প্রুফ গাড়িতে তুলে দেন তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অবসরপ্রাপ্ত স্কোয়াড্রন লিডার আব্দুল্লাহ আল মামুন ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব মো. তারিকুল্লাহ। শেখ হাসিনার এই দুজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা এখনো শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রেনেডের অসংখ্য স্পিন্টার।

সেদিন আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী মিছিলের আগে সমাবেশের জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের মাঝখানে ট্রাকের ওপর মঞ্চ করা হয়। ট্রাকের পেছনে বাঁ দিকে একটি সিঁড়ি ছিল মঞ্চে ওঠার জন্য।

ট্রাকের শেষ মাথায় ডানদিকে রাখা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দেন। মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির কয়েক গজের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল হাসিনার বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ গাড়িটি।

সেদিনের কথা স্মরণ করে তার নিরাপত্তা কর্মকর্তা মামুন বলেন, আপার (শেখ হাসিনা) বক্তৃতা তখন শেষের দিকে। উনার দুই পাশে মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা দাঁড়িয়েছিলেন।

আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তৃতা চলার পুরোটা সময় মামুন ট্রাকের ওপরে রাখা টেবিলের পাশে বসেছিলেন। সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়ানো ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর শোয়েব। আর গাড়ির কাছে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক আহমেদ সিদ্দিক।

আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, কয়েক বছর আপার সঙ্গে থেকে বুঝতে পারতাম- কখন উনার বক্তৃতা শেষ হবে। সেদিনও বক্তৃতা শেষ হবে বুঝতে পেরে উঠে আপার কাছে যাচ্ছিলাম। টেবিলটার ঠিক কোণায় পৌঁছাতেই প্রথম গ্রেনেড ফাটল। এর পরপরই আরও তিনটি বিস্ফোরণ হয়। চারদিকে ধোঁয়ায় আছন্ন হয়ে যায়। নেত্রীর পাশে শুধু আমি আর মোহাম্মদ হানিফ। হানিফ ভাই আপাকে বসানোর চেষ্টা করছেন। আমিও বসে পড়তে বললাম। কিন্তু আপা বসতে চাচ্ছিলেন না। এক পর্যায়ে তাকে প্রায় জোর করে বসালাম।

হানিফ ভাই আপার মাথা টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে দিলেন। আমার দৃষ্টি তখন আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে বাটার দোকানের দিকে। তবে মনে হচ্ছিল রমনা ভবনের আশপাশ থেকে গ্রেনেড ছোড়া হচ্ছে। এর মধ্যে ট্রাকের আশপাশে আরো তিনটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। ট্রাকের সিঁড়ির শেষ প্রান্তে দাঁড়ানো শোয়েব চিৎকার করে মামুনকে বলেন, যেন শেখ হাসিনাকে দ্রুত নামিয়ে আনা হয়।

মামুন বলেন, আপাকে নিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই ট্রাকের পেছনের ডালায় একটা গ্রেনেড এসে বাড়ি খেয়ে পাশেই বিস্ফোরিত হল। সম্ভবত ওই বিস্ফোরণেই ট্রাকের তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে যায়। গ্রেনেড বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপাকে নিয়ে আমি আবার আগের জায়গায় সরে আসি।

 

 

 

 

 

ইতোমধ্যে নেতাকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে তৈরি করেন মানবঢাল। মামুন, মোহাম্মদ হানিফ, মোফাজ্জল হোসেন মায়া, নজিবউদ্দিন আহমদ (শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই) তাকে ঘিরে ধরেন।

কিন্তু শোয়েব তখন তাগাদা দেন, তেলের ট্যাংক ফুটো হয়ে গেছে, শেখ হাসিনাকে ট্রাকের ওপর নিয়ে আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। যে কোনো মুহূর্তে ট্রাকে আগুন ধরে যেতে পারে।

সেই মুহূর্তের কথা মনে করে মামুন বলেন, আমি কোনো দিকে না তাকিয়ে আপাকে ধরে দাঁড়ালাম। তার পায়ে স্যান্ডেল ছিল না, চশমাও খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সিঁড়ির মাঝখান পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পর শোয়েব ভাইও আপাকে ধরলেন। তাকে নিয়ে সোজা গাড়ির সামনে বাঁ দিকের সিটে বসানো হল।

কিন্তু আহতদের ছেড়ে শেখ হাসিনা যেতে চাইছিলেন না জানিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রায় জোর করে তাকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে সুধা সদনে নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রাক আর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মাঝখানের জায়গায় বেশ কয়েকটি ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে ছিল। হামলায় আহতরা কাতরাচ্ছিলেন।

আপা বললেন, ‘এদের কী হবে? এদের রেখে তো যাওয়া যাবে না।’ আপার কথায় কান না দিয়ে ড্রাইভার মতিন ভাইকে (মোহাম্মদ আব্দুল মতিন) বললাম- গাড়ি চালান। শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে সেদিন গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্রিন্টার বিদ্ধ হয় তারেক আহমেদ সিদ্দিক, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শোয়েব মো. তারিকুল্লাহর দেহে। শোয়েবের ধারণা, যারা সেদিন গ্রেনেড ছুড়ছিল, তারা শেখ হাসিনার অবস্থান ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছিল।

 

 

 

 

 

তিনি বলেন, আপাকে ট্রাক থেকে নামানোর জন্য প্রথমবার চেষ্টা করার সময়েই ট্রাকের পেছনের ডালায় একটি গ্রেনেড এসে পড়ে। আর তাকে গাড়িতে তোলার পরপরই গাড়ির দিকে ছোড়া হয় গুলি।

মামুন বলেন, “গাড়িতে ওঠার পর আপা বললেন, তোমরা ঠিক আছ তো! কিন্তু উনি কানে ঠিকমত শুনতে পাচ্ছিলেন না। সুধা সদনে ফেরার পথে খেয়াল করলাম আমাদের আশপাশে পুলিশের কোনো গাড়ি নেই।

সচিবালয়ের সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে শহীদ মিনার, পলাশী পেরিয়ে ইডেন কলেজের সামনে প্রথম ট্রাফিক সিগন্যালে পড়ি। এরপর নিউ মার্কেটের সামনে দিয়ে পিলখানার ভেতর দিয়ে আমরা সুধা সদনে পৌঁছাই। গাড়ির পেছনে সিটে আমি, শোয়েব ভাই আর তারেক স্যার ছাড়াও মায়া ভাই ও নজিব ভাই ছিলেন।

সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ অগাস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে।

২১ অগাস্ট হামলায় নিহত অন্যরা হলেন শেখ হাসিনার দেহরক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রহমান, হাসিনা মমতাজ, রিজিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), রতন শিকদার, মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মোশতাক আহমেদ, লিটন মুনশি, আবদুল কুদ্দুছ পাটোয়ারী, বিল্লাল হোসেন, আব্বাছ উদ্দিন শিকদার, আতিক সরকার, মামুন মৃধা, নাসিরউদ্দিন, আবুল কাসেম, আবুল কালাম আজাদ, আবদুর রহিম, আমিনুল ইসলাম, জাহেদ আলী, মোতালেব ও সুফিয়া বেগম। একজনের পরিচয় এখনও জানা যায়নি।