প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ বিয়ে-শাদি বা নিকাহ্
- Nov 02, 2018
- অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম
আরবীতে বিয়ে-শাদিকে বলা হয় নিকাহ্। আর বৈবাহিক চুক্তি বা বিয়ে বন্ধন হচ্ছে আক্্দ। একজন পুরুষ ও একজন নারীর স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বৈধ পন্থায় সাক্ষীদের সামনে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়াটাই হচ্ছে বিয়ে। আর এই বিয়ের মধ্য দিয়ে দাম্পত্য জীবনের শুভ সূচনা হয় এবং পরিবার গঠনের সুদৃঢ় পথ প্রশস্ত হয়। বিয়ের মাধ্যমে একজন পুরুষ এবং একজন নারী পরস্পরের জীবনের যাবতীয় কর্মকা-ের সাথী হয়ে যায়, তাদের একত্রে বসবাসের সামাজিক স্বীকৃতি লাভ হয়। তাদের প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, মিলন এবং তাদের সন্তান-সন্তুতি পবিত্রতার সৌরভে সুরভিত হয়।
ইসলাম বিয়ে-শাদির ওপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে, তবে ক্ষেত্র বিশেষে নিরুৎসাহিতও করেছে। যারা দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যহীন তাদের ক্ষেত্রেই বিয়ে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবদুল্লাহ্্ ইবনে মাসউদ রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম, বলেন, ইয়া মাশারাশ্্শাবাবি মানিসতাতা’আ মিনকুমুল বা’আতা ফালইয়াতাযাওয়াজ ফাইন্নাহু আগাদ্্দু লিল্্ বাসারি ওয়া আহ্্সানু লিল্্ ফারজি ওয়া মাল্লাম ইয়াসতাতি ফা’আলায়হি বিসসওমি ফাইন্নাহু লাহু ভিজাউ- হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ে-শাদি করার সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে, কেননা তা দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং গুপ্ত অঙ্গকে হিফাজত করে, আর যার সামর্থ্য নেই সে যেন রোজা রাখে। (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)।
এই হাদিসখানি থেকে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, যার দৈহিক সামর্থ্য নেই এবং যার স্ত্রীর খোরপোষ দেয়ার মতো আর্থিক সচ্ছলতা নেই তার উচিত হবে বিয়ে না করে সংযমী হওয়া। যখন সে সংসারের ব্যয় নির্বাহের মতো সচ্ছলতা অর্জন করবে এবং দৈহিকভাবে সমর্থ হয়ে উঠবে তখন অবশ্যই সে বিয়ে করবে।
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : ওয়াল ইয়াসতা ‘ফিফিল্লাযীনা লা ইয়াজিদুনা নিকাহান হাত্তা ইউগনিয়া হুমুল্লাহু মিন্্ ফাদ্লিহিÑ যাদের বিয়ে-শাদি করার মতো সামর্থ্য নেই তারা যেন সংযম অবলম্বন করে যদ্দিন না আল্লাহ্ অনুগ্রহ করে অভাব মুক্ত করেন (সূরা নূর : আয়াত ৩৩)।
ইসলাম বিয়ে-শাদির ক্ষেত্রে কনের সম্মতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। কনের ইজিন (সম্মতি) ব্যতিরেকে বিয়ে হয় না। কনের থেকে প্রস্তাব আসে আর সেটা কবুল করে বর। এই ইজাব-কবুল সম্পাদিত হয় সাক্ষীদের সামনে। বিয়েতে কনের জন্য মহরানা নির্ধারণ করতে হয় এবং তা অবশ্য কনেকে দিতে হয়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে: ওয়া আতুন নিসাআ সাদুকাতিহিন্না নিহ্্লাতানÑ আর তোমরা নারীদের তাদের মহরানা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে (সূরা নিসা : আয়াত ৪)। মহর বা মহরানার হকদার কনে। পূর্বকালে রেওয়াজ ছিল, কনের অভিভাবকরা কনে পণ হিসেবে বর পক্ষ থেকে অর্থ আদায় করে তা কনেকে না দিয়ে নিজেরাই খরচাদি করত। আল্লাহ জাল্লাহ্ শানুহু এই প্রথাটিকে বাতিল করে দিয়ে উপরের আয়াতে কারিমায় মহরানার অধিকারী যে একমাত্র কনেই তা স্থির করে দিয়েছেন। বর কনে পক্ষ থেকে দাবি করে যে, অর্থ-সম্পদ আদায় করে তা ইসলামে বৈধ নয়। এই যৌতুককে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মহরানা নির্ধারণ এমনভাবে করার কথা বলা হয়েছে যা বর আদায় করতে সমর্থ। কেননা ওই মহরানা তাকে আদায় করতেই হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বড়লোকি দেখানোর জন্য বরের সাধ্যের বাইরে মহরানা ধার্য করা হয়। এটা আদৌ শরিয়তসম্মত নয়। মহরানা ধার্য হতে হবে বরের আর্থিক সামর্থ্যানুযায়ী। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : মহরানা নির্ধারণের পর কোন বিষয় পরস্পর রাজি হলে তাতে তোমাদের কোন দোষ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ্্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময় (সূরা নিসা : আয়াত ২৪)।
স্ত্রীকে মহরানার টাকা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দিতে হবে। যদি দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রীর বনিবনা না হওয়ার কারণে পরিস্থিতি দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এবং পরিণতিতে তা বিয়ে-বিচ্ছেদ পর্যায়ে উপনীত হয় তবুও স্বামী কোন অবস্থাতেই মহরানা যা স্ত্রীকে প্রদান করেছে তার কিছুই ফেরত নিতে পারবে না। এমনকি পোশাকাদি-গয়না যা দিয়েছে তাও ফেরত নিতে পারবে না। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : একজনকে অগাধ অর্থও দিয়ে থাক তবুও তা হতে কিছুই প্রতিগ্রহণ করবে না (সূরা নিসা : আয়াত ২০)। মহরানা নির্ধারণে জটিলতা সৃষ্টি হলে বোন, ফুফুদের মহরানার নিরিখে ধার্য করা যেতে পারে, একে বলা হয় মহরানার মিছল।
মহরানাকে আমাদের দেশে দেনমোহর বলে। এই মহরানা কনের সম্মান ও মর্যাদার প্রতীক। এটা তার অধিকার। মহরানা কমপক্ষে কত ধার্য করা যেতে পারে সে সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। তবে আমাদের ইমাম ইমামে আজম হযরত আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হির মতে দশ দিরহামের কম মহরানা হতে পারে না। উল্লেখ্য, দশ দিরহামকে আমরা শ তোলা রুপার মূল্যের হিসাবে গণ্য করতে পারি। এর বেশি কত ধার্য করা যায় তা নির্ভর করবে বরের সামর্থ্যরে ওপর।
হযরত আলী করামাল্লাহ ওয়াজ্্হাহুর সঙ্গে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ্্ সাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর কন্যা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাতুয্্ যাহ্রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হাকে বিয়ে দেন। এই বিয়েতে যে দেনমোহর ছিল তা চার শ’ দিরহাম। এটা মহরানা ফাতিমা। জানা যায়, হযরত আলী রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর বয়স ছিল ২৪ বছর আর হযরত ফাতিমা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হার বয়স ছিল প্রায় ১৯ বছর।
আল্লাহ্্ জাল্লাহ্ শানুহুর নির্দেশ পেয়ে প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম তাঁর নয়নমণি কন্যা ফাতিমা (রা)-কে বললেন: আমি তোমার শাদি আলীর সঙ্গে দেয়ার আদেশ পেয়েছি, এ ব্যাপারে তোমার সম্মতি চাই। এ কথা শুনে হযরত ফাতিমা (রা) কাঁদতে কাঁদতে বললেন : আব্বা! আপনি আমাকে একজন দরিদ্র কুরায়শের হাতে সমর্পণ করতে যাচ্ছেন! হযরত রসূলুল্লাহ (সা) বললেন : সেই মহান সত্তার কসম যিনি আমাকে সত্যসহ পাঠিয়েছেন, তাঁর থেকে অনুমতি না পেলে আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতাম না।
(বাকী অংশ আগামী শুক্রবার)
লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ,
উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা)