• Friday, September 20, 2024

শিল্পকলা সংস্কারে, মহাপরিচালক সৈয়দ জামিল আহমেদের ইশতেহার

  • Sep 14, 2024

Share With

নন্দিত নাট্য নির্দেশক ও শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে একাডেমিতে যোগদান করেছেন। সেই সূত্রে  ১১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টায়, জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে একাডেমি নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিশ্রুতির কথা বিস্তারিত জানান। ১২টি শিরোনামে তুলে ধরেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আইনের ফাঁক, সমাধানের রূপকল্প, কট্টরপন্থি বাধা, বৈশ্বিক সংযোগ বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক মুক্তিসহ প্রায় সবটুকু। অনেকটা মহাপরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে সেটি যথাযথ পালনের লক্ষ্যে ইশতেহার প্রকাশের মতো। ভোটের বাজারে যেটির উল্টো চিত্র দেখে আসছেন ভোটাররা! এবার সেই রীতিতে বদল এনে ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ যেন আশার মশাল জ্বালিয়ে দিলেন অন্ধকার হয়ে আসা দেশের শিল্প-সংস্কৃতির দেয়ালে। সেই মশাল থেকে নিংড়ানো আলোর পুরোটাই তুলে ধরা হলো হুবহু-

বর্তমান আইনের পর্যালোচনা

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯-এর ধারা ২ থেকে ধারা ১৩-এর ৩নং উপধারা পর্যন্ত কোথাও বস্তুত এই একাডেমি বলতে রাষ্ট্র কী মনে করে এবং এর ভিশন (রূপকল্প) কী তা স্পষ্ট হয় না।

এই আইনের ৪নং ধারা অনুযায়ী, ‘একাডেমির সাধারণ পরিচালনা ও প্রশাসন একটি পরিষদের উপর ন্যস্ত থাকিবে এবং পরিষদ সেই সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কাজ করিতে পারিবে যাহা একাডেমি কর্তৃক প্রযুক্ত ও সম্পন্ন হইতে পারে।’

কিন্তু সাধারণ পরিষদ গঠনের বিধি সংবলিত ৫নং ধারায় বর্ণিত ১৩টি উপধারা পর্যালোচনা করে প্রতীয়মান হয় যে একাডেমি যেন সরকারের আজ্ঞাবহ একটি দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত ও পর্যবসিত হবার ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে।

অথচ ৩নং ধারার ২নং উপধারায় বলা হয়েছে, ‘একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হইবে।’

একাডেমির ক্ষমতা ও দায়িত্ব সংক্রান্ত ৭নং ধারায় বর্ণিত ১৫টি উপধারাগুলোর অস্পষ্টতা, সীমাবদ্ধতা ও অপপ্রয়োগে বিগত সকল শাসনামলেই লক্ষ করা গেছে।

ফলে, পদলেহী শিল্পীদের দ্বারা সরকারি শিল্পকর্ম যাচ্ছেতাইভাবে সৃষ্টি করে একাডেমি একটি অনুগত ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

রূপকল্প

অতএব, ২০২৪-এর রক্তস্নাত জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-উত্তর এই সময়কে একদিকে সম্ভাবনাময়, অন্যদিকে এক ক্রান্তিক্ষণ রূপে বিবেচনা করা যায়।

এমন একটি সময়ে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান আইনের ৪ থেকে ১৩নং ধারা পর্যন্ত স্থগিত বা বাতিল করার প্রয়োজনীয়তার দিকে সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

তাই, একাডেমির ভিশনকে পুনরায় নির্ণয় করার প্রয়োজনীয়তা এখন এই নতুন সময়ের নতুন দাবিতে পরিণত হয়েছে। গতকাল যেমন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সচিবদের বৈঠকেও সকল স্তরে সংস্কার পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের তাগিদ লক্ষ করা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা এবং ছাত্র-নাগরিক সমাজের মধ্যে হাজির সেই তাগিদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নতুন রূপকল্প নির্ণয় করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি হবে বিবিধ সংস্কৃতির হাজার মালভূমি দিয়ে গঠিত সৃষ্টি-কৃষ্টির এক যৌথ জমিন। এক জাতি, এক রাষ্ট্র, এক নেতা, এক ভাষা, এক ধর্ম ও এক মতাদর্শভিত্তিক সাংস্কৃতিক চর্চাকে একাডেমি সর্বদা ‘না’ বলবে।

বরং, বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু ভাবাদর্শভিত্তিক সৃষ্টি-সৌন্দর্য-আনন্দের এক সংলাপাত্মক জনগণতান্ত্রিক শিল্প-পরিসর রূপে গড়ে উঠবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দেশজ সংস্কৃতি ও বিশ্ব-সংস্কৃতির যোগসাধন করে একাডেমি এক নতুন দিনের সাংস্কৃতিক অনুশীলনের সেতুবন্ধন ঘটাবে।

সংস্কৃতি কেবল আনন্দ-বিনোদনের ক্ষেত্র নয়। সংস্কৃতি হলো সেই নান্দনিক ক্রিয়া, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্তর্গত সকল নাগরিকের সম্মিলিত জীবনীশক্তির পরিচয় প্রতিফলিত হয়। সংস্কৃতির চর্চায় জাতীয় জীবনের প্রাণস্পন্দন উপলব্ধি করা যায়। কেননা সংস্কৃতি জীবনের অর্থ নির্মাণ করে। জীবনের বিকাশ ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে সংস্কৃতি মানবজীবনের একেবারে কেন্দ্রে থাকে।

কারণ, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিকাশে-উৎকর্ষে-সৃজনে-গঠনে-রূপান্তরে-সমৃদ্ধিতে সংস্কৃতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, সঞ্জীবনী ভূমিকা পালন করে।

এখানে দুটো দৃষ্টান্ত প্রাসঙ্গিক: সদির নৃত্য ১৯৩২ সালে রুক্মিণি দেবী ভরতনাট্যম-এ রূপান্তর করে বিশ্বে ভারতীয় আত্মপরিচয় তুলে ধরে সাংস্কৃতিক গৌরব অর্জন করে চলেছে। সিঙ্গাপুর ব্যাপক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করার পরও সাংস্কৃতিক অভিজাত্য সন্ধানে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রশ্নে যুক্ত হয়ে দৃঢ়ভাবে বলা যায় যে ইসলামের সঙ্গে সাংস্কৃতিক চর্চার কোনও বিরোধ নেই। সেই বিরোধিতার দর্শন ও বাস্তবতার জ্ঞান নিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আরও সবল বেগে পরিচালিত হতে হবে।

পূর্ববর্তী রেজিমে সৃষ্ট একাডেমির প্রাতিষ্ঠানিক স্বৈরতান্ত্রিক পরিচালন-পদ্ধতি ও স্বভাবকে বদলে দিতে হবে।

স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক একাডেমিতে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে একে একটি কার্যকর বহুত্ববোধক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে।

এই অভিলক্ষ্য নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এই জন্য নীতিনির্ধারণী সম্মতি ও সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দৃষ্টান্ত অনুসরণে শিল্পী-সাহিত্যিক-সংগঠক-সাংস্কৃতিক উদ্ভাবকদের ফেলো রূপে গণ্য করে চর্চা ও গবেষণার সংশ্লেষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে যথার্থ অর্থে ‘একাডেমি’ রূপে গড়ে তুলতে এই মুহূর্তে কাজ শুরু করতে হবে।

কাঠামোগত ও অবকাঠামোগত—উভয় প্রকার সংস্কার ও রূপান্তরের লক্ষ্যে রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।

এই কাজের জন্য মহাপরিচালককে সহায়তা করতে প্রয়োজনে খণ্ডকালীন এক বা একাধিক পরামর্শক-উপদেশক-গবেষক নিয়োগ দিয়ে অতি দ্রুত একটি সংস্কার সেল গঠন করতে হবে।

বাজেট বৃদ্ধি ও এর নীতি

তাই, রাষ্ট্রের রূপান্তরেও কেবল ‘ইনফ্রাসট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট’ নয় বরং ‘হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট’ ধারণাকে একটি অন্যতম নীতিরূপে গণ্য করতে হবে।

এই নীতি অনুযায়ী সংস্কৃতি খাতে জিডিপি’র কমপক্ষে তিন শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে আর্থিকভাবে সক্ষম ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলার প্রয়োজন স্বীকার করে প্রযোজ্য সমর্থন ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

একাডেমির বিকেন্দ্রীকরণ

একাডেমির বাজেট বাড়িয়ে জেলা ইউনিটগুলোকে স্থানীয় সাংস্কৃতিক স্বায়ত্তশাসিত এককে পরিণত করতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

স্থানীয় বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিগুলোর প্রদর্শন, পুনঃসৃজন ও উদ্ভাবনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।

কারণ, লোকজ শিল্পী ও জনগণের পরিসর রূপে জেলা শিল্পকলা একাডেমিগুলোকে গড়ে তুলবার আর কোনও বিকল্প নেই।

সাংস্কৃতিক চর্চায় কট্টরপন্থি বাধা অপসারণে সরকারের দায় ও দায়িত্ব মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চায় সকল প্রকার কট্টরপন্থি অসহিষ্ণু মতাদর্শিক ও ধর্মীয় বাধা ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ ও মোকাবিলা করতে হবে।

এই লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় নীতি ও ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাংস্কৃতিক সুরক্ষা বলয় ও ‘কালচারাল জাস্টিস’ নিশ্চিত করার সুস্পষ্ট রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার থাকতে হবে।

রাষ্ট্র, সরকার ও একাডেমির ত্রিমুখী সম্পর্ক

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সরকারি যথেচ্ছাচারমূলক ইচ্ছা পূরণের তল্পিবাহক প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হবার দুষ্টচক্র থেকে শিল্পকলা একাডেমিকে বের করে আনা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।

বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে গঠিত জনগণের সাংস্কৃতিক ইচ্ছাকে উপলব্ধি করে একাডেমিকে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে প্রয়োজন সর্বাত্মক জরুরি তৎপরতা।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে এই দেশের জনগণের বহুত্ববোধক সাংস্কৃতিক ইচ্ছার কাছে দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান রূপে গণ্য করতে হবে।

এবং এর মহাপরিচালককে সাংস্কৃতিক উপদেষ্টার নিকট দায়বদ্ধ থাকতে হবে ও জবাবদিহি প্রদান করতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার সাংস্কৃতিক চিন্তা অনুযায়ী বলা যায় যে রাষ্ট্রীয় সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে শুধু একরৈখিকভাবে কল্পনা করা যাবে না।

দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে অপরাপর বৈশ্বিক সংস্কৃতির সংলাপ ও সংশ্লেষ ঘটাতে হবে।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে তাই বিশ্বযোগ ঘটাবার কালচারাল ডিপ্লোম্যাসি ও গ্লোবাল ক্রিয়েটিভিটির ভরকেন্দ্র হিসেবেও ভাবতে হবে। এবং একাডেমির সংস্কার ও রূপান্তরের জন্য গৃহীত সকল উদ্যোগে এই ভাবনাকে বিবেচনায় রাখতে হবে।

দুর্নীতিমুক্ত একাডেমি গঠন

দুর্নীতির অসৎ প্রক্রিয়া অনুসন্ধান, দুর্নীতির কারণ চিহ্নিতকরণ ও নিশ্চিহ্নকরণে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সেই লক্ষ্যে একজন ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইজার স্বল্পকালীন সময়ে নিয়োজিত করে আর্থিক দুর্নীতির খাত ও কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে।

সেই মোতাবেক আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেই কেবল একাডেমির নতুন অভিযাত্রা সূচনা করা সম্ভব।

আশু করণীয়

২১টি জেলার শিল্পকলা একাডেমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো সচল ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে মহাপরিচালকের জরুরি ভিজিট ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন হবে।

এই কাজে, সর্বক্ষেত্রে, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের সংযুক্তি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই যোগসাধনে কী করণীয় তা সর্বাগ্রে নির্ধারণ করতে হবে।

কেন্দ্রীয় শাখায় কনজারভেটরি স্থাপন করে বহুমুখী শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ-সৃজন কর্ম দ্রুত সূচনা করে জনগণের আস্থা ফেরাতে হবে।

স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয়

এই তিন কাল পর্বে, একাডেমিকে নতুন দেশের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সচল করতে বস্তুত দরকার হলো সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর।

এই লক্ষ্য পূরণে মহাপরিচালকের দায়-দায়িত্ব, ক্ষমতা-পদসোপান ও জবাবদিহি অবশ্যই পুনর্নির্ধারণ করতে হবে।

এভাবেই নতুন মহাপরিচালক তার প্রথম সংবাদ সম্মেলন এবং একাডেমির ভবিষ্যৎ রূপকল্প শেয়ার করেছেন। সঙ্গে নিজেকেও জবাবদিহির কাঠগড়ায় দাঁড়া করানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বিপরীতে সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদে একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে ছিলেন নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী। যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির হাজারও অভিযোগ নিয়েও তিনি ছিলেন নিজ পদে হাসিমুখে অবিচল!

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন