জন্মদিন ॥ ইতিহাসের ইলা মিত্র
- Oct 17, 2018
- ডি.এম তালেবুন নবী
ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মহান ধারক ও মহানায়ক নাচোলের রানীমাতা ইলা মিত্র। আগামীকাল তার ৯৩তম জন্মদিন। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অবহেলিত, অনগ্রসর লালমাটির বরেন্দ্রভূমি নাচোল বলতেই পরিষ্কারভাবে সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে বা পরিচয় ঘটে প্রথমেই একটি পোড়খাওয়া মর্মান্তিক ইতিহাসের; যার ঐতিহ্য একান্ত নিজস্ব। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে থাকে জীবন্ত এই ঐতিহ্য। যার অপর নাম সামনে চলার অমোঘ মন্ত্র। যার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অধিকার আদায়ে মুক্তির আন্দোলন। আর এসব কিছুর মূল মন্ত্রদাতা হচ্ছে এক সময়ের রানীমাতা ইলা মিত্র। তার চলার পথ ছিল রক্তের ধারায় পিচ্ছিল। তারপরও যুগযুগ ধরে পৃথিবীতে অধিকার আদায়ের যত আন্দোলন হয়েছে। তার মূল ধারার নির্যাস নিয়ে তুমুল আন্দোলন করেছেন। একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে বা লক্ষ্যে পৌঁছতে সব কিছু তুচ্ছ করে আন্দোলনে আত্মাহুতি যে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল, তা আজও প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। যার ঠিকানা অসীমকালের গড়ে ওঠা চিরবঞ্চিতদের একটা নতুন ঠাঁই। আর এই ঠিকানায় পৌঁছতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষত্ব হচ্ছে নাচোলের সংগ্রামী ইলামিত্র। যার অপর নাম কৃষক বিদ্রোহ ও তেভাগা আন্দোলন। এই উপমহাদেশে অতীতে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়ন। তার আগে গঠিত হয়েছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। গড়ে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের প্রতিশ্রুতিই হলো ‘তেভাগা সংগ্রাম’। তেভাগা আন্দোলনে চিরস্মরণীয়দের একজন অহঙ্কারের মেয়ে ইলামিত্র। সংগ্রামী, ত্যাগী একটি জীবনের নাম নাচোলের ইলামিত্র।
জমিদার আর সুদখোর মহাজনদের শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এই মহীয়সী নারী। তার দুর্বার আন্দোলনে সেদিন সর্বপ্রথম এই মহীয়সী নারী আদিবাসী সাঁওতাল, ওঁরাও, রাজবংশীদের সঙ্গে এক করে দিয়েছিল হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙালীকে। তিনি মাঠে নেমে একান্তভাবে অবলোকন করেন সংখ্যালঘিষ্ঠ উপজাতীদের সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী গরিব কৃষকরা গায়ের ঘাম কঠোর-কঠিন শক্ত বরেন্দ্রের লালমাটিতে ফেলে যে ফসল উৎপন্ন করে তার সবটাই নিয়ে যায় জোতদার, মহাজন আর জমিদাররা। গায়েগতরে খেটে সব খরচ যুগিয়ে যে ফসল উঠবে তার দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ দিতে হবে উৎপাদনকারীকে অর্থাৎ কৃষককে। এই দাবিতেই গড়ে ওঠে তেভাগা আন্দোলন। আন্দোলনের এই দাবানল ছড়িয়ে পড়ে রংপুর, দিনাজপুর, যশোর, খুলনা, মালদহ, চব্বিশপরগনা, জলপাইগুড়িসহ ১৯ জেলায়। ১৯৪৬-৪৭ সালে শুরু হওয়া এই মারমুখী দুর্বার আন্দোলন স্থায়ী হয়েছিল ১৯৪৯-৫০ সাল পর্যন্ত। মালদহ তথা রাজশাহী জেলা, বিশেষ করে নাচোলের তেভাগা আন্দোলন ও সংগ্রামের মূল নেতৃত্ব ছিল ইলামিত্রের হাতে।
তেভাগা আন্দোলন দমনের নামে ইলামিত্রের নেতৃত্বে সংগঠিত কৃষকদের ওপর অস্ত্রধারী পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। নাচোলের ঘাসুড়া গ্রাম। কৃষকদের সঙ্গে সংঘর্ষে দারোগাসহ চারজন পুলিশ নিহত হলে পাকি শাসকরা আদিবাসীদের ওপর প্রচ- নিপীড়ন চালাতে শুরু করে। অনেকটাই ভেঙ্গে পড়ে নাচোলের প্রতিরোধ আন্দোলন। তেভাগা আন্দোলন নির্মূলে সরকার সেনাবাহিনী তলব করলে দু’হাজার সৈন্য আমনুরা স্টেশনে নামে। নাচোলের অধিকাংশ আদিবাসী গ্রাম ঘিরে ফেলে। সৈন্যরা ১২ গ্রাম পুড়িয়ে অসংখ্য গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে চ-ীপুর গ্রামে গিয়ে পৌঁছে। এই সময়ে পুলিশ ও আনসার সৈন্যবাহিনীর ছত্রছায়াতে গ্রামে ঢুকে লুটপাট এবং নির্বিচারে নারী-পুরুষের ওপর অত্যাচার চালায়। বহু সাঁওতাল নিহত হয়। এই সময়ে শত শত সাঁওতাল পরিবার এলাকা ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করে। রানীমাতা অকপটে লিখে স্বীকার করেছে ‘নারীর অবমাননার রক্তপাতের কথা কিভাবে ভুলি এবং কেনইবা ভুলব? তবে কিছু সুহৃদ মানুষের কথা ভোলা যায় না। দিনের পর দিন আমার শিরায় রক্ত যোগাতে হয়েছে। এ কথাটাও কিভাবে ভুলি, সেই লাল জীবন (রক্ত) মুসলমান ভাইদের দেহ থেকে সংগৃহীত হয়েছিল। রক্তের কোন জাত আছে কিনা জানি না- যদি থেকে থাকে তবে আমি অবশ্যই জাতহীন।” এমন ঘোষণা যিনি দিয়ে গেছেন তিনি কত বড় মানুষ তা ভবিষ্যত ইতিহাস বলবে। তাই রানীমাকে অনেকেই মহামানব বলে থাকেন। কিংবাদন্তি তুল্য ইলামিত্রের জন্ম ১৯২৫ সালে। কলকাতাতে জন্মের সুবাদে পড়াশোনা করেছেন বেথুন স্কুল ও কলেজে। ১৯৪৪ সালে বাংলায় অনার্স করেন বেথুন কলেজ থেকে। এর ৮ বছর পর ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে ঐ বছরই কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ১৯৯০ সালে অবসরে যাবার পরেও জনসেবা থেকে পিছিয়ে আসেননি। ১৯৭২ থেকে ৭৭ পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার এমএলএ ছিলেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু মুক্তিযোদ্ধা তার আশ্রয়ে থেকে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন।
ইলামিত্রের সংগ্রামী জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে প্রেরণা হিসেবে উঠে আসে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। একটি সাক্ষাতকারে প্রশ্নের জিজ্ঞাসায় ইলামিত্র বলেন: শেখ মুজিব আমার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। আমি তখন ঢাকা কারাগারে ছিলাম, তখন বঙ্গবন্ধু পাশের সেলে ছিলেন। আমার বিরুদ্ধে যে ১০/১২ টি মামলা ছিল তা বঙ্গবন্ধুকে তুলে নেয়ার কথা বললে তিনি উচ্চৈস্বরে হেসে বলেছিলেন, এখন তো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। সেসব মামলা নিয়ে আপনি আর ভাববেন না। আপনাকে আমি ডবল সিটিজেনশিপ দেব। জেলখানায় আপনি যে ঘরে ছিলেন সে ঘরটি নতুনভাবে সাজিয়ে আপনার নামে নামকরণ করব। সেসব কথা আমার খুব মনে পড়ে। (১৯৯৬ সালের একটি সাক্ষাতকার থেকে) একই সাক্ষাতকারে অপর এক প্রশ্নে ইলামিত্র বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমি খু উচ্চ ধারণা পোষণ করি। তার হত্যাকা- আমাকে ব্যথিত করেছে। আমি যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম তখন তার বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়েছিলাম। একই সঙ্গে বলেন, বাইরে-ভেতরে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছিল, আর এই ষড়যন্ত্র করেই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে ইলামিত্র বলেছিলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা অনেক বেশি প্রগ্রেসিভ খালেদা জিয়ার থেকে।
ইলামিত্রের সেই কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গেছে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর। তাকে তার সংগ্রামী জীবনের মধ্যে যেমন খুঁজে পাওয়া যাবে তেমনি তার জীবদ্দশাতে বেশ কয়েকটি রুশ গ্রন্থ অনুবাদ করেন। ‘হিরোশিমার মেয়ে’ বইটির জন্য তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার লাভ করেন। এ ছাড়াও ভারত সরকার তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী আখ্যা দিয়ে তা¤্রপত্র পদকে ভূষিত করে।
শুধু তার সংগ্রামী কর্ম জীবনের স্মৃতি ধরে রাখতে নাচোলে ৫০ বছরেও কিছু করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদ প্রশাসক জেলা আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈনুদ্দিন ম-ল একেবারে নিজ উদ্যোগে ইলামিত্রের স্মৃতি নাচোলে ধরে রাখতে কেন্দুয়াতে ‘তেভাগা স্মৃতিস্তম্ভ’ ও ইলামিত্র পাঠাগার নির্মাণ করেছেন। তারপরও ইলামিত্র বেঁচে থাকবেন সাধারণ সংগ্রামী মানুষের মনে ও বাঙালী কৃষক ও উপজাতি সাঁওতাল সংগ্রামীদের অনুপ্রেরণা হয়ে।
লেখক : সাংবাদিক, প্রকাশিত : ১৭ অক্টোবর ২০১৮ দৈনিক জনকণ্ঠ