উন্নয়ন ও প্রধানমন্ত্রী
- Oct 23, 2018
- মিল্টন বিশ্বাস
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর এদেশের মানুষের এগিয়ে যাওয়ার সকল উদ্যম রহিত হয়। মানসিকভাবে হতোদ্যম এদেশবাসী ২১ বছর সামরিক শাসকদের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে। কীভাবে প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে সামনে যেতে হবে, কীভাবে বিশে^র দরবারে নিজেদের অধিকারের কথা বলতে হবে, কীভাবে দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখাতে হবে তার সবই সেসময় নির্বাসিত, অন্তর্হিত। যেন প্রভাতে প্রদীপের সলতে পাকানোর কোন লোক নেই, সন্ধ্যায় আলোক প্রাপ্তি তো দূরের কথা! তারপর এল ১৯৯৬ সাল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বাঙালীর অহঙ্কার হয়ে উঠলেন। জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী নিয়ে তিনি মানুষের সামনে দাঁড়ালেন। দেশের রাজনীতিতে সমাজ সংস্কার আর অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়ে উঠল মূলমন্ত্র। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মঙ্গল চিন্তায় ব্যাপিত হলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন’ গ্রন্থের নাম প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, ‘আমাদের দেশের জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য কর্মসূচী প্রয়োজন। আর্থ-সামাজিক কর্মসূচীকে আরও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সুখ-সুবিধা নিশ্চিত করা, শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, সুস্থ সবল জাতি গঠন করা। রাজনীতি হতে হবে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে। দেশকে আমরা কী দিতে পারলাম সেটাই একজন রাজনীতিবিদের চিন্তা-ভাবনা হতে হবে। দেশ কী দিল তা বড় কথা নয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই বড় কথা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচী নিয়ে। আজকের প্রতিযোগিতা হতে হবে অর্থনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে। সামাজিক কর্মসূচী নিয়ে।’ (রচনাসমগ্র ১, পৃ. ২১৩)
এই উদ্ধৃতির সূত্র ধরে বলতে হয়, শেখ হাসিনার সৎ, বলিষ্ঠ এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই আজ বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনের বিবেচনায় তিনি বিশ্বের প্রভাবশালী দশ নারী নেত্রীর একজন মনোনীত হয়েছেন। অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তার দিক থেকেও শেখ হাসিনার সমকক্ষ হিসেবে কাউকে চিন্তা করার কোন অবকাশ নেই। ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট-এর সর্বশেষ জরিপে দেখা যায় যে, ৭৭.৭ শতাংশ বিশ্বাস করে বাংলাদেশ সঠিক নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে, যা ২০১৫ সালে ছিল ৬২ শতাংশ। এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা দিন দিন অপ্রতিরুদ্ধভাবে বেড়েই চলেছে। এমন নেতৃত্বের কারণেই মহাকাশে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রযুক্তিগতভাবে তার অগ্রসরতা জানান দিয়েছে। সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স নীতি’ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুসংহত করার পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশ গত দশ বছরে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ যে পথ পাড়ি দিয়েছে, তাকে ‘অসাধ্য সাধন’ বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ১১ অক্টোবর (২০১৮) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ২০ জেলায় ৩৩টি প্রকল্পের উদ্বোধনকালে তিনি এ কথা বলেন। তাঁর কারণেই ‘আমরাও পারি’ এই শাণিত বাক্যে দীক্ষিত আজকের প্রজন্ম। তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি না, পৃথিবীতে কোন দেশ এত অল্প সময়ে এত উন্নতি সাধন করতে পারে কিনা। কিন্তু আমরা সেই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছি।’ প্রকৃতপক্ষে গত দশ বছরে জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন এবং দিনবদলের যাত্রা শুরু হয়েছে।
॥ দুই ॥
শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত।’ ধৈর্য ও সাহসের প্রতিমূর্তি শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের মানসকন্যা, দেশরতœ, কৃষকরতœ, জননেত্রী- বহুমাত্রিক জ্যোতিষ্ক। তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর নেতৃত্বে আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশ। তিনি অন্য রাজনীতিবিদদের চেয়ে প্রকৃতপক্ষে আলাদা, ভিন্ন, স্বতন্ত্র ও নেতৃত্বের গৌরবজনক আসনে সমাসীন। তিনি জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী অর্থনৈতিক বিকাশ ত্বরান্বিত করেছেন; জাতীয় সঙ্কট উত্তরণে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি জনতার আকাক্সক্ষাসমূহ এবং টিকে থাকার বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধনের সাহায্যে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর নেতৃত্বের সাফল্যে বাংলাদেশ আজ গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
বর্তমান প্রজন্মের কাছে শেখ হাসিনা এক সাহসী রাজনীতিকের নাম; যাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় ভবিষ্যতের বাংলাদেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে চলেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি পাল্টে গেছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার রায় ঘোষিত হয়েছে (১০ অক্টোবর, ২০১৮)-এর আগে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-, জেল হত্যাকা- ও বিডিআর সদস্য কর্তৃক সেনাসদস্যদের হত্যার বিচারসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচার তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তরুণ প্রজন্ম প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি-জামায়াতকে। বিএনপি-জামায়াতের সহিংস বীভৎসতাকে। অতীতে সহিংসতা, জ্বালাও-পোড়াও আর পেট্রলবোমায় মানুষ হত্যা করে তারা থামাতে পারেনি যুদ্ধাপরাধের বিচার। দমে গেছে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতা। শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, কূটনীতিক দিক থেকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন। তিনি মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সব বিরূপ পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিয়ে এসেছেন। তাঁর মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক। কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও উন্নয়ন সহযোগী ও অংশীদার বানিয়ে ফেলেছেন রাশিয়াসহ অন্য অনেক দেশকে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়েছে। ২০১৫ সালের মে মাসে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়ার প্রক্রিয়ার সূচনা সে কথা আরও বেশি করে জানান দিচ্ছে। তাঁর সরকারের উন্নয়নের মডেল অন্যান্য দেশের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল নির্মাণের অগ্রগতি দেশবাসীকে অবাক করেছে ।
বর্তমান মেয়াদে (২০১৪-২০১৮) প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এ প্রকাশিত ‘পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ ওয়ান এ্যান্ড অনলি ওয়ান’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসন ন্যায়সঙ্গত। সেটার কারণ দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সফলতা। ১১ অক্টোবর (২০১৮) প্রকাশিত সংবাদ থেকে আমরা জেনেছি, বিশ্বব্যাংকের ‘মানবসম্পদ সূচক’ বলছে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ মানব সম্পদ উন্নয়নে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় এগিয়ে আছে। একটি শিশুর শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং টিকে থাকার সক্ষমতা বিচার করে ভবিষ্যতে তার উৎপাদনশীলতা এবং আয়ের সম্ভাবনা বোঝার চেষ্টা করেছে বিশ্বব্যাংক। এর ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে তাদের ‘মানবসম্পদ সূচক’, দেখানো হয়েছে একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে এখন যাদের বয়স ১৫ বছর, তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশের প্রত্যাশিত আয়ু হবে ৬০ বছরের বেশি। এদিক দিয়ে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা রয়েছে একই কাতারে। ভারতে এই হার ৮৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ৮৪ শতাংশ, নেপালে ৮৫ শতাংশ। বাংলাদেশে প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ৬৪ জন কোন ধরনের শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই বেড়ে ওঠে। ভারতে এই সংখ্যা ৬২, পাকিস্তানে ৫৫, শ্রীলঙ্কায় ৮৩। এই সূচকে উন্নতির অন্যতম কারণ হলোÑ শেখ হাসিনার আমলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগ বেড়েছে। ২০০৯ সালে তিনি ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে দারিদ্র্যের হার দ্রুত কমে এসেছে।
গ্রামীণ জীবনের ব্যাপক রূপান্তরে শেখ হাসিনার অবদান অতুলনীয়। এ বিষয়ে তাঁর ভাবনার বিকাশ অনেক আগে থেকে। তিনি লিখেছেন, ‘গ্রামকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক কর্মকা- গড়ে তোলার জন্য নতুন নতুন চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। গ্রামগুলোকে কেন্দ্র করেই অর্থনৈতিক কর্মকা- পরিচালিত হতে পারে। প্রতিটি পরিবার যদি যতœবান হয়, আধুনিক প্রযুক্তি ও চিন্তাভাবনা গ্রহণ করে- তাহলে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা অর্জন করতে পারে।’ (পৃ. ২১৬) শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য ও সেবাকেন্দ্র চালু রয়েছে। এসব তথ্যকেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সরকারী ফরম, নোটিস, পাসপোর্ট ও ভিসা সংক্রান্ত তথ্য, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সেবাবিষয়ক তথ্য, চাকরির খবর, নাগরিকত্ব সনদপত্র, পাবলিক পরীক্ষার ফল, বিদেশে চাকরিপ্রাপ্তির লক্ষ্যে রেজিস্ট্রেশনসহ ২২০টি সেবা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু মোবাইল ব্যাংকিং, জীবন বীমা, মাটি পরীক্ষা ও সারের সুপারিশ, বিদ্যুত বিল পরিশোধ এবং জমির পর্চাসহ অন্যান্য সেবা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রায় ৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে। উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা টেলিমেডিসিন সিস্টেমসহ চলছে। মোবাইল টেলিফোন সিমের সংখ্যা ১৫ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। আর থ্রি-জির পর ফোর-জি (২০১৮) প্রযুক্তি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ব্যাপকভাবে। মোবাইল ফোনেই ভিডিও-কল করা যাচ্ছে এখন; টিভি দেখা হচ্ছে; ইন্টারনেটের গতি বেড়েছে। ফলে টেলি-কনফারেন্স এখন সহজ ব্যাপার। এভাবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এছাড়া আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এজন্যই চীন-জাপান-ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানসহ বিশ্বের সকল নেতারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মতে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব অনিবার্য।
চলবে…
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়